হ্যাঁ - অন্ধ বা জন্মান্ধরাও ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে। তবে তাদের স্বপ্নগুলো ভিজ্যুয়াল বা দৃষ্টিগ্রাহ্য স্বপ্ন নয়। তারা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে যে ইন্দ্রিয়গুলো (শ্রবণ, স্পর্শ বা ঘ্রাণের দ্বারা অনুভব) ব্যবহার করেন স্বপ্ন দেখার সময় সেগুলোই উদ্দীপিত হয়ে ওঠে।
বিষয়টি নিয়ে ডেনমার্কের একদল গবেষক ২০১৪ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। গবেষণাটি ৫০ জন ব্যক্তির উপর পরিচালিত হয়। এদের মধ্যে ১১ জন ছিলেন জন্মান্ধ, ১৪ জন জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে দৃষ্টি হারিয়েছিলেন এবং বাকি ২৫ জন স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। চার সপ্তাহ ধরে চলে পর্যবেক্ষণ। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক সদস্যকে তারা ঘুমিয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখেছেন সেগুলো লিখে জমা দিতে বলা হয়। অন্ধ সদস্যবর্গের জন্য টেক্সট টু স্পিচের ব্যবস্থা করা হয়।
তাদের এরকম কিছু প্রশ্ন করা হয় - আপনি স্বপ্নে কি কিছু দেখতে পেয়েছিলেন? দেখতে না পেলে শুনতে বা কোনো গন্ধ পেয়েছিলেন? কোনো ব্যথা অনুভব করেছিলেন কি? অথবা কোনো কিছুর স্বাদ?
এসবের বাইরেও কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল – আপনি কি স্বপ্নের মধ্যে ভয় পেয়েছিলেন? কারো উপর রাগ হয়েছিল কি আপনার? দুঃখ পেয়েছিলেন কি? তাদেরকে দুঃস্বপ্নের ব্যাপারেও জিজ্ঞাসা করা হয়।
যারা স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন তাদের স্বপ্নগুলো ছিল ভিজ্যুয়াল বা চাক্ষুষ। আর যারা দেখতে পেতেন না তারা তাদের স্বপ্নগুলো শ্রবণ, ঘ্রাণ বা স্পর্শের দ্বারা অনুভূতি করেছিলেন। অন্ধদের কেউ স্বপ্নের মধ্যে খাবারের স্বাদ পেয়েছিলেন, কেউ গন্ধ শুঁকেছিলেন, কেউ বা স্বপ্নে কোনো শব্দ বা আওয়াজ শুনেছিলেন। তাদের কেউ দেখেছেন তাকে কেউ তাড়া করছে এবং তিনি দৌড়াচ্ছেন, কেউ গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছিলেন, কেউ তার কুকুর হারিয়ে ফেলেছিলেন, কেউ নিজেকে ম্যানহোলের মধ্যে পড়ে যেতে দেখেছিলেন।
গবেষকদল লক্ষ করেন, স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের চেয়ে অন্ধদের দুঃস্বপ্ন দেখার প্রবণতা বেশি। স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের স্বপ্নে দুঃস্বপ্ন থাকে ৬ শতাংশ যেখানে অন্ধদের থাকে ২৫ শতাংশ। চারগুণের একটু বেশি। এর কারণ কি? স্বপ্ন নামক প্রক্রিয়াটি পুরোটাই ঘটে মস্তিষ্কে। মানুষ সারাদিন যা দেখে, যা শুনে, যা ভাবে বা যা কিছুর মুখোমুখি হয় স্বপ্নে সেগুলোই প্রকারান্তে ঘুরেফিরে আসে। অন্ধরা সারাদিনে চলাফেরা করতে স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন একজন মানুষের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। তাদের জীবনযাত্রায় ঝুঁকি বা বিপদের পরিমাণ বেশি থাকে। এজন্য তাদের স্বপ্নে দুঃস্বপ্নের পরিমাণ বেশি।
আরেকটি কারণ হল, মস্তিষ্ক স্বপ্ন দেখানোর মাধ্যমে দৈনন্দিন চলাফেরা বা কাজকর্মের ঝুঁকির ব্যাপারে কিছুটা উপযোগী করে তোলে। স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের চেয়ে অন্ধদের দৈনন্দিন জীবনে ঝুঁকি খানিকটা বেশি থাকে। তাই তাদের মস্তিষ্কে দুঃস্বপ্ন দেখার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
এবার আসা যাক যারা জীবনের একপর্যায়ে গিয়ে দৃষ্টি হারিয়েছিলেন তাদের কথায়। যারা জীবনের প্রথমদিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন অন্ধ হওয়ার পরেও কিছুদিন তাদের স্বপ্নে ভিজ্যুয়াল ইম্প্রেশন থাকে। তবে, দিনে দিনে সেগুলোর পরিমাণ কমে আসে। একপর্যায়ে একদমই থাকে না। দৃষ্টিহীন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে তাদের স্বপ্নগুলো দৃষ্টিগ্রাহ্যতা হারিয়ে পুরোপুরি অনুভূতিগ্রাহ্য হয়ে যায়।
জার্মানির জেডডিএফ ব্রডকাস্টিং কোম্পানি কর্তৃক প্রযোজিত একটি ছোট্ট তথ্যচিত্রে অন্ধমানুষেরা কিভাবে স্বপ্ন দেখে সেটি তুলে আনা হয়। তথ্যচিত্রটিতে পিটার পার্কের নামক একজন জন্মান্ধ জানান যে, স্পর্শ, শ্রবণ এবং গন্ধের মাধ্যমে তিনি তার আশেপাশের সব বস্তুকে অনুভব করার চেষ্টা করেন। চলাফেরা করার সময় তিনি প্রধানত এ তিনটি ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করেন। ঘুমোতে যাওয়ার পরে তিনি যে স্বপ্নগুলো দেখেন সেগুলোও এ তিনটি ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই অনুভব করেন। -সংগৃহীত ।
